ফিলিস্তিন ইস্যুতে চুক্তির দোহাই দেওয়া জিহাদ বিরোধীদের একহাত নিলেন বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী আলেম ও পাকিস্তান শরীয়াহ কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি মুফতী ত্বকী উসমানী।
বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) ইসলামাবাদে জাতীয় ফিলিস্তিন সম্মেলনে বক্তৃতায় ফতোয়া বিরোধী ও কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় মুসলিম বিশ্বের সরকারদের ভর্ৎসনা করেন।
তিনি বলেন, ৫৫ হাজারেরও বেশি কালেমা পাঠকারী মুসলিমকে জবাই হতে দেখেও কি আপনাদের উপর এখনো জিহাদ ফরজ নয়? অথচ ফিলিস্তিনিদের জন্য জান-মাল লাগিয়ে দেওয়া মুসলিম উম্মাহর সকলের উপর ফরজ। আমাদের সরকার সহ বিশ্বের সকল ইসলামী সরকারের উপর এখন জিহাদ ফরজ হয়ে গিয়েছে।
কেনো এখনো মুসলিম দেশগুলোকে ইসরাইল-আমেরিকার চুক্তি মেনে চলতে হবে এই বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, গাজ্জায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি হওয়ার পরও বোমাবর্ষণ চলছে। জায়োনিস্ট ইসরাইল কোনো নৈতিকতা ও আন্তর্জাতিক আইনের ধার ধারছে না। তারা ও তাদের দোসররা কোনো ধর্ম, বিশ্বাস ও চুক্তির মান রাখছে না। উল্টো আমেরিকার অস্ত্র ও সার্বিক সহায়তায় জারজ রাষ্ট্রটি মুসলিম দেশগুলোকে ভীত করে রেখেছে।
গাজ্জার এক চিকিৎসকের বার্তা এসেছে, “গাজা শেষ নিঃশ্বাস নিচ্ছে, আমরা তোমাদের অনেক অপেক্ষা করেছি। কিন্তু তোমরা আসোনি – আল্লাহ হাফেজ।”
আজ গাজ্জা দখলের ও একে মুসলিমদের গণকবরে পরিণত করার পরিকল্পনা প্রকাশ পাচ্ছে। ট্রাম্প বলছে গাজ্জাকে ফিলিস্তিনিমুক্ত করে একে বিনোদন নগরীতে পরিণত করবে। যেনো সে পুরো পৃথিবীকে নিজের সম্পত্তি মনে করছে।
নিজ রাষ্ট্র ও পৃথিবীর একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রধারী মুসলিম দেশ পাকিস্তানের সরকারের প্রতি দ্রুত ফরজ হুকুম আদায়ে পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমাদের সাথে ইসরাইলের যখন কোনো চুক্তি নেই তবে ভয় কিসের? কিসের এত অপরাগতা?
এছাড়া পাকিস্তান সহ পুরো মুসলিম বিশ্বের সরকারদের উদ্দেশ্য করে বলেন, তারা যেহেতু হেসেখেলে চুক্তি ভঙ্গ করছে তবে আমরা কেনো চুক্তির বাধ্যবাধকতায় পড়ছি?
বক্তৃতায়, গাজ্জাকে বাঁচিয়ে রাখতে আবশ্যিকভাবে জায়োনিস্ট ইসরাইল ও তাদের সমর্থন করে এমন কোম্পানিগুলোর পণ্য সম্পূর্ণরূপে বয়কট করার আহবান জানান তিনি। বয়কট ও প্রতিবাদ কর্মসূচি যেনো শান্তিপূর্ণ হয় ও অন্যের জান-মালের কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখার দিকনির্দেশনা দেন।
এছাড়া ইসরাইল যত শক্তিশালীই হোক না কেনো পাকিস্তানের জনগণ সর্বদা অখণ্ড ফিলিস্তিনের প্রতি নিজেদের সমর্থন অব্যাহত রাখবে জানান।
পাকিস্তান কখনো ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়নি ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ একে অবৈধ সন্তান বলেছিলেন বলেও সকলকে স্মরণ করিয়ে দেন। সরাসরি ফিলিস্তিনের ভূমিতে জিহাদে অংশগ্রহণ করার পরিবর্তে সভা-সম্মেলন করতে হচ্ছে দেখে অনুশোচনা করেন। দু:খ ও লজ্জা প্রকাশ করেন।
এর আগে গত ৪ এপ্রিল শুক্রবার আন্তর্জাতিক মুসলিম উলামা ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিন ইস্যুতে একটি ফতোয়া জারি হয়। যেখানে বলা হয়,
১. প্রত্যেক সক্ষম মুসলিমের উপর ফিলিস্তিনে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদ করা ফরজ।
২. আরব ও মুসলিম মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর জন্য অবিলম্বে সামরিক হস্তক্ষেপ করা ফরজ।
৩. দখলদার ইহুদি রাষ্ট্রকে স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথে সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ করা ফরজ। সবধরণের জলপথ, প্রণালী এবং আরব-মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর আকাশসীমাও এই হুকুমের অন্তর্ভুক্ত।
৪. জিহাদরত প্রতিরোধ আন্দোলন (হামাস সহ সকল স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র দল) কে আর্থিক, সামরিক, রাজনৈতিক ও মানবিক সহ সর্বক্ষেত্রে সহায়তা করা ফরজ।
৫. উম্মাহর সুরক্ষা ও আক্রমণকারী শত্রুদের প্রতিহত করতে অবিলম্বে ইসলামি সামরিক জোট গঠন করা ওয়াজিব। এটি এমন ওয়াজিব যা অবিলম্বে পালনীয়।
৬. ইহুদিবাদী দখলদার রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপন (স্বীকৃতি ও সহযোগিতা) সম্পূর্ণরূপে হারাম।
৭. ইহুদিবাদী দখলদার রাষ্ট্রকে পেট্রোল ও গ্যাস সরবরাহ করাও সম্পূর্ণরূপে হারাম।
৮. ইহুদিবাদী দখলদার রাষ্ট্রের সাথে আরব দেশগুলোর করা শান্তি চুক্তি সমূহ পুনরায় পর্যালোচনা করা জরুরী।
৯. গাজ্জায় আমাদের মুসলিম ভাইদের সহায়তায় আর্থিক জিহাদ করা এবং দ্রুত এর (গাজ্জার) সীমান্ত খুলে দেওয়া ফরজ।
১০. আমেরিকার মুসলিমদের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে, তারা যেনো ট্রাম্প ও তার সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। যেনো তিনি তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেন। আগ্রাসন বন্ধ করেন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।
কিন্তু মিশরের গ্র্যান্ড মুফতী নাজির আইয়াদ মিশরের সাথে ইসরাইলের ক্যাম্প ডেভিডের মতো শক্তপোক্ত চুক্তি থাকায় গত ৮ এপ্রিল এই ফতোয়া বাস্তব সম্মত নয় বলে বিরোধিতা করেন। কোনো ইউনিয়ন বা সংস্থার ফতোয়া জারি করার অধিকার নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ফিলিস্তিনে প্রত্যেক সক্ষম ব্যক্তির উপর জিহাদ ফরজ হওয়ার ফতোয়াটি আন্তর্জাতিক মুসলিম উলামা ইউনিয়নের ইজতিহাদ ও ফতোয়া কমিটির ১৫ জন বিশেষজ্ঞ মিলে তৈরি করেন। ফিলিস্তিন, মুসলিম বিশ্বের বাস্তবতা ও শরীয়াহর নিরিখে তারা এই ফতোয়া জারি করেন।
তারা হলেন –
১.শায়েখ মুহাম্মদ হাসান আদ-দিদো
২. শায়েখ আব্দুল হাই ইউসুফ
৩. শায়েখ ইবরাহীম আবু মুহাম্মদ
৪. শায়েখ খালেদ হানাফি
৫. শায়েখ আহমদ কাফি
৬. ড. ফরিদা সাদিক জাউজ
৭. শায়েখ মুহাম্মদ গুরমাজ (মেহমেত গরমেজ)
৮. শায়েখ মুস্তফা দাদিশ
৯. শায়েখ সালেম আশ-শায়খী
১০. শায়েখ মাসউদ সাবরী
১১. শায়েখ ওয়ানিস আল-মুবারক
১২. শায়েখ উ’জাইল আন-নাশমী
১৩. শায়েখ নুরুদ্দিন আল-খাদেমী।
১৪. শায়েখ শায়েখ আহমদ হুয়াই
১৫. শায়েখ সুলতান আল-হাশেমী
ফতোয়া কমিটির প্রধান শায়েখ ড. আলি আল কারাহদাগী ও সম্পাদক এডভোকেট ফজল আব্দুল্লাহ মুরাদও এই ফতোয়া প্রস্তুত ও চূড়ান্তকরণে অংশগ্রহণ করেন।