পরিবারতন্ত্র বনাম শেখ মুজিব

বাংলাদেশের রাজনীতি ও প্রশাসনে পরিবারের প্রভাব দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত বিষয়। শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামল থেকে শুরু করে তার কন্যা শেখ হাসিনার বর্তমান শাসনকাল পর্যন্ত, “পরিবারতন্ত্র” শব্দটি রাজনীতির কেন্দ্রে উঠে এসেছে। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হলেও তার শাসনকালে পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অন্যদিকে, শেখ হাসিনার দীর্ঘ মেয়াদের শাসনকালে পরিবারের প্রতিপত্তি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আরও জোরালো হয়েছে।

শেখ মুজিবের সময়ে পারিবারিক রাজনীতির সূচনা এবং শেখ হাসিনার বর্তমান শাসনামলে পরিবারতন্ত্রের প্রসার ও তার পরিণতি বিশদভাবে আলোচনা করা হলো।

শেখ মুজিবের শাসনকাল: পরিবারতন্ত্রের সূচনা?

শেখ মুজিব ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি এবং গণমানুষের নেতা। তার নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জনগণের আশা ছিল নতুন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা, যা হবে স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক। তবে তার শাসনকালে পারিবারিক রাজনীতির অভিযোগ উঠে।

  • পরিবারের প্রভাব:
    শেখ মুজিবের ভাই শেখ নাসেরসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা রাষ্ট্রীয় কাজে সরাসরি জড়িত না থাকলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব লক্ষ করা যায়। তাদের বিরুদ্ধে সম্পদের অপব্যবহার এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছিল।
  • স্বজনপ্রীতি:
    প্রশাসন এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তার আত্মীয়-স্বজনদের জড়িত করার অভিযোগ ছিল। বিশেষ করে তার ভাই এবং ঘনিষ্ঠজনদের বিভিন্ন পদে অঘোষিত প্রভাব ছিল।
  • রাজনৈতিক প্রভাব:
    আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে মুজিব পরিবারের সদস্যদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে অনেকেই স্বজনপ্রীতির উদাহরণ হিসেবে দেখেছেন।

যদিও পারিবারিক প্রভাব তখন সীমিত ছিল, একদলীয় শাসনব্যবস্থা (বাকশাল) প্রতিষ্ঠার পর ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার অভিযোগ আরও শক্তিশালী হয়।

শেখ হাসিনার শাসনকাল: পরিবারতন্ত্রের প্রসার ও এর ফলাফল

শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সাল থেকে বিভিন্ন মেয়াদে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার নেতৃত্বে দেশের উন্নয়ন এবং অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য হলেও, পরিবারতন্ত্রের অভিযোগও ক্রমাগত জোরালো হয়েছে।

১. পরিবারের সদস্যদের রাজনৈতিক প্রভাব

শেখ হাসিনার শাসনামলে তার পরিবার, বিশেষত ভাই ও নিকট আত্মীয়রা রাজনীতি ও প্রশাসনে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন।

  • শেখ রেহানা, তার বোন, রাজনীতিতে সরাসরি সক্রিয় না হলেও নীতিনির্ধারণে বিশেষ ভূমিকা পালন করছেন বলে দাবি করা হয়।
  • শেখ হাসিনার সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় দেশের রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত নীতিনির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করেছেন। তবে তার কোন নির্বাচিত পদ নেই।
  • মুজিব পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা সংসদ সদস্য এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন, যা পরিবারের প্রভাবের প্রমাণ।

২. দুর্নীতির অভিযোগ

শেখ হাসিনার শাসনামলে পরিবারতন্ত্রের অন্যতম সমালোচিত দিক হলো দুর্নীতির বিস্তার।

  • পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলা: যদিও এই প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়।
  • ব্যাংক ও অর্থনৈতিক খাতে লুটপাট: শেখ হাসিনার শাসনামলে ব্যাংক খাতে শীর্ষ পর্যায়ের দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। পরিবার এবং দলীয় নেতাদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন বিশ্লেষকরা।

৩. স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা

শেখ হাসিনার শাসনকাল গণতন্ত্রের উপর অবিচার এবং বিরোধী দলের দমনের জন্য সমালোচিত।

  • নির্বাচনকে প্রভাবিত করা: ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ব্যাপক বিতর্কিত ছিল। বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করেছে, ভোটারদের ভয় দেখিয়ে এবং কারচুপি করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে।
  • বিরোধী দল দমন: বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং নিপীড়নের ঘটনা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে।

৪. বাকস্বাধীনতার দমন

শেখ হাসিনার শাসনামলে গণমাধ্যম এবং বাকস্বাধীনতার উপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।

  • ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করে সমালোচকদের দমন করা হয়েছে।
  • সংবাদমাধ্যমে সেন্সরশিপ এবং সাংবাদিকদের হয়রানির ঘটনা ব্যাপকভাবে আলোচিত।

৫. পরিবারের ক্ষমতা কুক্ষিগত করা

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এমনভাবে পরিচালিত হয়েছে, যেখানে বিরোধিতা সহ্য করা হয় না।

  • দলীয় অভ্যন্তরে ভিন্নমতাবলম্বীদের কোণঠাসা করে রাখা হয়।
  • পরিবারের সদস্যদের জন্য দলের শীর্ষ পদগুলো সুরক্ষিত রাখা হয়।

পরিবারতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র

পরিবারতন্ত্র গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। জনগণের জন্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পরিবর্তে ক্ষমতা একটি নির্দিষ্ট পরিবারের কাছে কেন্দ্রীভূত হলে শাসনব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত ও স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠে।

  • শেখ মুজিব বনাম শেখ হাসিনা:
    শেখ মুজিবের সময়ে পরিবারতন্ত্রের শুরু হলেও তা সীমিত আকারে ছিল। শেখ হাসিনার শাসনকালে পরিবারতন্ত্র ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে এবং দেশের প্রশাসন, অর্থনীতি, এবং রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

প্রভাব ও পরিণতি:

১. প্রশাসনিক দুর্বলতা: পরিবারতন্ত্রের কারণে যোগ্য ব্যক্তিদের পরিবর্তে স্বজনপ্রীতি বাড়ে, যা প্রশাসনিক দক্ষতা নষ্ট করে।
২. গণতান্ত্রিক কাঠামো দুর্বল হওয়া: বিরোধী দল ও গণমাধ্যমের দমন, নির্বাচন কারচুপি এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রবণতা গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
৩. সামাজিক অস্থিরতা: জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ে, যা দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে

শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ স্বাধীন করার অবিস্মরণীয় অবদান রাখলেও তার শাসনকালে পরিবারতন্ত্রের শুরুর অভিযোগ উঠেছিল। তবে তার শাসনকালের সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটিগুলো তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র আকারের ছিল।

শেখ হাসিনার শাসনকাল একদিকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সমৃদ্ধ হলেও, অন্যদিকে পরিবারতন্ত্র ও ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি করেছে।

“পরিবারতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র” প্রশ্নে বাংলাদেশকে একটি কার্যকর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির মডেলে রূপান্তর করতে হলে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

ইনকিলাব জিন্দাবাদ